২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও ভাষা শহিদ দিবস বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করুন ।

নিজ মাতৃভাষাকে ভালোবাসুন, অন্যের মাতৃভাষাকেও শ্রদ্ধা করুন ।
আপনার দৈনন্দিন জীবনে আরোবেশি আরোবেশি বাংলায় কথা বলুন ।

বাংলা পড়তে বা লিখতে না জানলে । 'অভ্র' ডাউনলোড করে নিন এখানে ক্লিক করে http://www.omicronlab.com/

Monday, February 18, 2013

'অন্য নিষাদ 'ভাষা প্রণাম' 
               ২১শে ফেব্রুয়ারি ২০১৩

     “একুশ মানেই বাংলা ভাষা 
      এই একুশের দর কত
,    একুশ মানেই রফিক সালাম 
     জব্বর আর বরকতও
     একুশ মানেই ভাষা দিবস 
     একুশকে তাই বন্দিরে
     একুশ মানেই দুঃখ-সুখের
                                                              বন্যা মনের মন্দিরে
 গদ্য ও কবিতায় আঠাশ টি লেখা - লিখেছেন -
শৌনক দত্ত তনু, লাবণ্যকান্তা, নন্দিতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, সতীশ বিশ্বাস, অলক বিশ্বাস,  সৌমিত্র চক্রবর্তী, সপ্তাশ্ব ভৌমিক,  মৌ দাশগুপ্তা, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়,আলি রেজা,শর্মিষ্ঠা ঘোষ, পার্থ কর, অনুপম দাশ শর্মা, 
শ্রী শুভ্র, এবিএম সোহেল রসিদ,তরুণ বসু,শামিম পারভেজ,অভিলাষা, জুলফিকার শাহাদাৎ, 
                 প্রবীর বিকাশ সরকার, মিত্রপক্ষ সাই, দেবতোষ মাইতি ,মৌ  মধুবন্তী, মৃন্ময় দেব , অমিতাভ দেব চৌধুরী ও ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় 

সম্পাদকীয়



        ‘অন্য নিষাদ’১১৯তম সংখ্যা ভাষা প্রণাম সংখ্যা রূপে প্রকাশিত হ’লো । গদ্য ও কবিতায় সাতাশটি লেখা দিয়ে সাজালাম একুশের ভাষা প্রণাম । ভাষা দিবস যেমন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবীতে ১৯৫২’র রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিন, তেমনই বিশ্বের যেকোন প্রান্তে সব ভাষাগোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে সম্মান   
                    প্রদর্শনের দিনও ।

শুনতে ভালো লাগবেনা, এ বাংলায় একুশের ভাষা শহীদ স্মরণে আমাদের আবেগেও কিছু ফাঁকিবাজি আছে । ১৯৬১’র উনিশে মে’র বরাক উপত্যকার  মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ১১জন শহীদের জীবন দানের কথা আমরা ভুলে যাই, কিংবা বড়ই ক্ষীণকন্ঠে উচ্চারণ করি ।

বাঙ্গালির আর এক স্বদেশ বাংলাদেশেরসুখ্যাত ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন বরাকের ভাষা সংস্কৃতি চেতনার কথা এই ভাবে প্রকাশ করেছেন “১১জন শহিদের স্মৃতিস্তম্ভের ভেতরে সূর্য হয়ে আছে তাদের ভাষার লড়াইএর ইতিহাস”  সেই সূর্যের দীপ্তিতে একাত্মবোধ করবো না কেন আমরা বাংলা ভাষার তথাকথিত মূল ভুখন্ডের বাঙালিরা ! ঈশাণ বাংলাতো আমারই আত্মজ !
বরাক’এর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ ও একটি কবিতা সংগ্রহ করে দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই ‘ঈশাণের পুঞ্জমেঘ’ ব্লগকে ।

একুশে ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ও বটে । তাই এই দিনটাতে ১৯৬১র ভাষা শহীদকেও স্মরণ করার দিন । ‘অন্য নিষাদ’ একুশের ভাষা শহীদদের সঙ্গে ১৯৬১র উনিশে মের ভাষা শহীদদের প্রতিও প্রণাম জানাচ্ছে । এই সংখ্যার লেখাগুলি সেইভাবেই নির্বাচন করেছি ।

তোতলা কলমে একান্ত একুশ...
       শৌনক দত্ত তনু

জন্মসুতোর সাথে যে ভাষা জড়িত সে ভাষা উচ্চারিত হয় অনায়াসে কোন রকম বাড়তি তালিম ছাড়াই আর তাই সে ভাষা হয়ে ওঠে মাতৃভাষা।বিশ্বায়ন ও অভিবাসনের কারণে নতুনভাবে আলোচনার দাবি রাখে মাতৃভাষা।তারপর ও নিজ মাতৃভাষার গুরুত্ব স্বক্ষেত্রে আর সবকিছুর চেয়ে বেশি ভাষাবিদ লুই জাঁ কালভে মাতৃভাষার পরিবর্তে প্রথম ভাষার কথা বললেও তিনি যখন দেখলেন ইউরোপের অধিকাংশ দেশে শিশুমুখ ফুটে ওঠা প্রথম মা কিংবা ভাষা মাদার টাং [ইংরেজী], ইদিওমা মাতের্না [ইতালি], মুটস্প্রার্থে [জার্মানী] বলে থাকে। এই প্রথার কারণেই ধরে নেওয়া হয় মায়ের মুখে যে ভাষা আমারা শুনি সেই মায়ের ভাষাই আমরা উত্তরাধিকার হিসেবে পাই। আফ্রিকান ভাষার মাতৃভাষা সম্পর্কে মাতৃদুগ্ধ, স্তন, স্তন্যপায়ী জাতীয় মিথ প্রচলিত। অনেক দেশে প্রথম ভাষার মিথটি আবার বেশ মজার এবং অভিনব তারা প্রথম ভাষাটি মাটির সাথে সম্পৃক্ত করে কল্পনা করে। চীনা ভাষার পেন কুও ইয়ু ইমান এর আক্ষরিক মান আরো বিস্তৃত মূল জাতির ভাষা ঋগ্বেদ কিংবা অথর্ব বেদে মাতৃভাষা নিয়ে বেশ কিছু বর্ননার দেখা মেলে।দেখা মেলে কোরানশরীফের সুরা ইব্রাহিম ৪ এবং সুরা রোম ২২ এও।

সর্বক্ষেত্র আলো ছড়ানো রীবন্দ্রনাথ মাতৃভাষা নিয়ে কি বলেছেন তাতে নজর না দিলে মাতৃভাষাঢ় আলোচনা কিছুটা হলেও অপূর্ণ থেকে যাবে। কবিগুরু মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের মতো স্বাস্থদায়ক বলে একাধিকবার বলেছেন। তার মতে আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আত্নরক্ষার পক্ষে ইংরেজী শিক্ষার যেমন প্রয়োজন তেমনি মন ও তার ব্যবহারকে মূঢ়তামুক্ত করার জন্য তার প্রভাব মূল্যবান। তবে তার সবচেয়ে মূল্যবান কথাটি খুব পরিস্কার দূর দেশি ভাষার থেকে আমরা বাতির আলো সংগ্রহ করতে পারি মাত্র কিন্তু আত্মপ্রকাশের জন্য প্রভাত আলো বিকীর্ণ হয় আপন ভাষায়। রবীন্দ্র নাথ মাতৃভাষার প্রেমে অন্ধ ছিলেন তা নয় তিনি বহুভাষার প্রেমিক তার একটি উদাহরন মেলে তারই কথায় ১৯৩৬সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উত্‍সবের বক্তব্যে “আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী ভাষার সন্মানের আসন বিচলিত হতে পারবেনা। তার কারণ এ নয় যে,বর্তমান অবস্থায় আমাদের জীবনযাত্রায় তার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। আজকের দিনে ইউরোপের জ্ঞানবিজ্ঞান সমস্ত মানবলোকের শ্রদ্ধার অধিকার করেছে,স্বাজাত্যের অভিমানে এ কথা অস্বীকার করলে অকল্যান। আর্থিক ও রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে আত্নরক্ষার পক্ষে এই শিক্ষার যেমন প্রয়োজন তেমনি মনকে ও ব্যবহারকে মূঢ়তামুক্ত করবার জন্য তার প্রভাব মূল্যবান। যে চিত্ত এই প্রভাবকে প্রতিরোধ করে,একে অঙ্গীকার করে নিতে অক্ষম হয়, সে আপন সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ নিরালোক জীবযাত্রায় ক্ষীণজীবী হয় থাকেযে জ্ঞানের জ্যোতি চিরন্তন তা যে কোনো দিগন্ত থেকেই বিকীর্ণ হোক,অপরিচিত বলে তাকে বাধা দেয় বর্বতার অস্বচ্ছ মন”আমাদের মাতৃভাষার এখনও যে অবস্থা তাতে আমাদেরকে শুধু ইংরজী নয়,অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভাষা থেকেও জ্ঞান আহরণ করতে হবে।

মধ্যযুগের আদি পর্বে বাংলাদেশের শাসক ছিল দক্ষিণ ভারতীয় কর্নাটক,সেন রাজবংশ।তারা এ দেশ শাসন করত সংস্কৃত ভাষায়। এরপর মধ্যযুগে সমগ্র মুসলিম আমল জুড়ে তুর্কি,পাঠান এবং মোঘল আমলে সুবে বাংলার দরবারি ভাষা ছিল ফার্সি। আধুনিক যুগে এসে ইংরেজ আমল জুড়ে দুশ বছর আমরা শাসিত হয়েছি ইংরেজী ভাষায়। যদিও প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আর মধ্যযুগ জুড়ে বাঙালী হিন্দু মুসলমান সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষায়, বাংলা বর্ণমালায় বাংলা সাহিত্য রচনা করে গেছেন। সতের দশকের কবি আবদুল হাকিম এর একটি কবিতা মনে পড়ে- “যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবানী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায় নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়”'

যে নিরন্তর হাঁটে তার পায়ে ধুলো উড়েনা। ১৯৪৭এ দেশভাগের সময় বাংলাদেশীরা পাকিস্তানের সাথে যাবার সিদ্ধান্ত নতুন ভাগ্য লিখলো।পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হলো।পাকিস্তান আমলে উর্দু ভাষার আগ্রাসনে বাংলা ভাষা ক্ষতবিক্ষত হলো।বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বাংলা ভাষা কখনো রাষ্ট্রীয় বা সরকারী আনুকুল্য পায়নি।প্রশ্নটা এখান থেকেই শুরু।যারা পাকিস্তানের সাথে থাকতে চেয়েছে সাতচল্লিশের বাটোয়ারায় তারা মুসলমান রাষ্ট্রে থাকার বাসনাই পোষণ করেছিলো তা দ্বিধাহীন বলা যায়। তবে পাঁচ বছর পর তাদের রোষের কারণ কি কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার দায়ী? মোটেই তা নয় মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালী মুসলমান সমাজে সে সময় দ্বিধা দ্বন্দ্ব তৈরী হয়েছিলো। পত্রপত্রিকায় বির্তক ও হয়েছে বাঙালী মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু। শেষ পর্যন্ত নবাব আবদুল লতিফ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন আশরাফ বা উচ্চ শ্রেনীর বাঙালী মুসলমান যারা উর্দু জানেন বোঝেন এবং বলতে পারেন তাদের মাতৃভাষা উর্দু আর আতরাফ বা নিন্ম শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানদের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা।বলা বাহুল্য যে এই আতরাফের সন্তানরাই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ করেছে।কিন্তু এখানেই কি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস শেষ?ভাষা আন্দোলন ছিলো মুসলমান বাঙালীর প্রথম প্রায়ঃচিত্তের প্রথমধাপ।তা ৬৯,৭১,৯০ হয়ে এখনো বাঙালী করে চলছে।

          ১৯৫২সালের ২১ফেব্রুয়ারী ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে ভাষার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে যারা রক্তদিলো ১৯৯৯এ সেই ঐতিহাসিক একুশকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিলো।অথচ দুঃখের সাথেই বলতে হবে মাতৃভাষা তরুন চোখ একটি উত্‍সব হয়ে উঠেছে কেবল। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পাওয়ার এতবছর পরও ভাষা আন্দোলনের সঠিক তথ্য ইতিহাস বিশ্বদরবারে পৌচ্ছে দিতে আমরা আজো ব্যর্থ। এই প্রশাসনিক অবহেলা নিয়ে প্রতিবছর একুশের দিনে তর্ক বিতর্ক চলে বুদ্ধিজীবি মহলে তারপর যেই কে সেই ধুলি জমে।
বাংলা ভাষায় নিরলঙ্কার কেজো কথা যদি দেশি ভাষা হয় তবে তা সাহিত্যের ভাষা হতে পারেনা। বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিক অনিসুল হক একটি বিকৃত ভাষার জন্ম দিয়েছেন যার প্রভাব বর্তমান প্রজন্মকে মূলপ্রমিত বাংলা ভাষা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। কথ্য ভাষা কিংবা আঞ্চলিকভাষা এক জায়গায় সন্মানীয় কিন্তু তরুনদের মুখে যখন শোনা যায় যাবা,খাবা,দেবা,আসবা কিংবা নাটকে সাহিত্যে এইসব শব্দ ব্যবহার হয় অহরহ তখন ভাষা তার প্রাণ হারায়। হিন্দি ও ইংরেজী ভাষা সংমিশ্রনেও আজকের প্রজন্মের মুখে কথা শোনা যায়। তারচেয়েও দুঃখজনক একষট্টি বছরেও আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক জীবনে সর্বাবস্থায় বাংলা ভাষার প্রচলন করতে পারিনি। উচ্চ আদালতে এখনো বাংলা ভাষার অবস্থান হয়নি। বিভিন্ন বেসরকারী ইংরেজী ও আরবী স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়েও বাংলা ভাষা ঢুকতে পারছেনা।অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বাংলাদেশে গত বিশবছরে স্থাপিত পঞ্চাশটির ও অধিক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশটিতেই বাংলা ভাষা পঠন পাঠনের কোন ব্যবস্থা নেই।ফলে তরুন প্রজন্মের কাছে বাংলাভাষা আন্তরিকতায় পঠিত বা কথিত হয়ে উঠছে না।তারচেয়েও মজার বিষয় একুশ শতকের বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বাংলা ও ইংরেজী নামফলক বর্তমানে রোমান হরফে লিখিত হয় তাছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্র প্রায়শ ইংরেজী ভাষায় রচিত। মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেওয়া একমাত্র দেশ বাংলাদেশের ভেতরেই এই করুণদশা তখন বিশ্বায়নের পটভূমিকায় আন্তর্জাতিক ভাষার সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের বিভিন্ন ছোট বড় দেশে অসংখ্য ভাষাকে ধ্বংস করে ফেলেছে।আজ বাংলাভাষাও সেই ধ্বংসের শিকার হচ্ছে।

আমরা কেউই একভাষী নই।আপাতদৃষ্টিতে একভাষী দেশেও একাধিক আঞ্চলিক ভাষার জন্য প্রত্যেক মানুষই একেকজন বহুভাষী ব্যক্তি। ভাষাবিদদের মতে,একভাষিতা নিরক্ষরতার মতোই মন্দ। কারণ তা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। কিন্তু তদুপরি আমরা নিজেরাই সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাকে বিকৃত এবং হেয় করে ফেলেছি। টিভি সিরিয়াল থেকে এফ এম রেডিও ইন্টারনেট ফেসবুকে বাংলাকে বিদেশি হরফ বা বিদেশী ভাষার বিপুল মিশ্রণে এবং ব্যবহারের মাধ্যমে। আমরাই আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাভাষা ও তার বানান রীতি কে ধ্বংস করে চলছি রোজ। মাতৃভাষা মানেই একুশে ফ্রেব্রুয়ারির ভোরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে এসেই বলা নয় গুড মর্নিং ফুল দিতে এসেছেন বুঝি ? তাছাড়া একুশে ফ্রেব্রুয়ারি যদি মাতৃভাষার লড়াই হবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠি দেবার রক্তে রাঙানো হবে তবে আবদুল গফফার চৌধুরী কিংবা ভাষা সৈনিকরা কেন ৮ই ফাল্গুনকে ভাষাদিবস বলতে দ্বিধা করলেন? কেন মাতৃভাষার দিনটি বিদেশী মাস তারিখে পরিচিত হলো? বাঙালীরা কি ৮ই ফাল্গুন হলে উজ্জ্বীবিত হতো না!নাকি এই একুশে ফ্রেব্রুয়ারি আশরাফ বা উচ্চ শ্রেণীর বাঙালি মুসলমানদের পরিকল্পিত অস্থিত্বের স্বাক্ষর বাঙালী যে একটি ঐতিহ্যবাহী জাতি,এ জাতির যে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আছে। বাংলাভাষার স্বীকৃত গঠনমূলক কাল যে ৯৫০থেকে১২০০খ্রীষ্টাব্দ সে কথা একুশ জানান দিয়েছিল ফলে একুশের ছয় দশক পর আবার একটি বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে

একুশ এলেই
লাবণ্য কান্তা

একুশ এলেই শিউরে উঠি,
চোখে ভাসে রাঙা রাজপথ।
একুশ এলেই আবার ফিরে দেখি
বাহান্নর কাদানে গ্যাস আর একশ চুয়াল্লিশ ধারা।

একুশ এলেই আবার জেগে উঠি,
নতুন সাহসের উদ্দীপনায়।
একুশ এলেই দেয়ালে দেয়ালে
অ আ ক খ ঙ ণ রঙিন বর্নমালা,
আমার দুঃখিনী বর্নমালার হাতছানি।

একুশ এলেই কুঁয়াশা সরিয়ে নগ্ন
 পায়ে প্রভাত ফেরি ... ... ...।
একুশ এলেই হলুদ গাঁদার
আবার মালা গাঁথা ; আর

একুশ এলেই শহীদ মিনারে ফুটে
রক্ত রাঙা পলাশ ।

বাংলার জয় ...

নন্দিতা ভট্টাচার্য

রাষ্ট্র ঘুমিও না , জাগো
অনেক দিন ডেকেছ নাক , কুম্ভকর্ণ
মানুষ দিয়েছে সময়
আর নয় আর নয় ,

মুষ্টিবদ্ধ শাহবাগ
ঝরনা হয়েছে আজ
বেড়ি নেই পায়ে তার
সেজেছে আগুন সাজ ,

ভাষা মেখেছে বাংলা
স্বাধীনতা সাজ বাংলা
পথ দেখিয়েছে বাংলা
পথ দেখাবেই বাংলা ,

মাতৃভাষায় এনেছে জোয়ার
অন্ধ ধর্মে পেরেক হাজার .........

মশাল জ্বালাবে দুনিয়ার চোখে
দুর্নিবার দুর্নিবার ..................


ভাষাস্বর

রত্নদীপা দে ঘোষ





অতঃপর তোমার স্থান কাল পাত্র সন্তান বাৎসল্য ফুটে উঠলো রক্তপাতে 
অতঃপর আমার রক্তে চারিয়ে গেল চখাচখির চর ... দুঃখী উড়নতুবড়ি
সাঁতরে উঠি পাখির স্বরে
তুমি শ্রেষ্ঠ ঋতুবিদ্ , আমাকে শেখাও যুদ্ধবিদ্যার সালতামামি
দগ্ধ আদ্যাক্ষর দুদণ্ড শ্বাসের সাথে মিশিয়ে আমার অস্ত্রকলা
তুমি ধরে রাখো সময় । ছায়া ঘুরে দাঁড়ায় যখন একাত্তরের । ঈশ্বর প্রেরিত বাসস্থানে জমা সাদা করতল ,অবিভক্ত কুঁড়েঘরের স্নায়ু ... দশকের স্লেটমেঘ টেনে টেনে বাসা বাঁধি মনসা তর্জমায় । কখনো স্বান্ত্বনা কখনো প্রেরণার ফণা লকলক করে তোমার চোখে , কাঁটায় কাঁটায় মহুল বেজে শিখা । আমি শব্দের মধ্যে নাইতে নামি , পদাবলীর আকৃতি দেশলাইপাত্রে ছেড়ে যায় তোমার আগুন ...... ইতিহাসের মতো বৃদ্ধ স্তন ..তাম্রলিপ্ত অস্থি ………অনন্ত কুসুম কবেকার কস্তাপাড়!
আচমনে উথলে ওঠে শহীদ
বিজন নিঙরে শঙ্খ লাগে ... রক্ত জাগে ...ঢেউ
তুমি হল্কার মতো কৃষিভাষা
তুমি বিধাতা নামক ওষধিগাছের ক খ কুচি
তোমার গায়ে জড়ানো দাঁড়িকমার শিশির আর হসন্তহরিণ ...
তুমি উল্লাস মাভৈ ফেব্রুয়ারি !
রোদের পেটে পিঠে পবিত্রতম তোমার একুশ ঊষাচিহ্ন
অক্ষর বীজে অঙ্কুরিত সূর্য ওঠার ডাক ...

                                       সুধা



সতীশ বিশ্বাস

বস্তুত সুধা বলে অন্য কিছু নেই 
তুমি ছাড়া,হে মাতৃভাষা। 
জিভের ও শ্রবণের আহ্লাদ তুমি 
মগজ ও মননের প্রসন্নতা তুমি 
প্রাণের নিবিড়তর প্রশান্তি তুমি  
জীবনের প্রাপ্তি আর সার্থকতা তুমি 
তুমি ছাড়া এ পৃথিবী জলহীন ধু-ধু- বালিরাশি 
তুমি ছাড়া এ পৃথিবী ছায়াহীন নির্গাছ প্রান্তর 
তুমি ছাড়া এ পৃথিবী জননী জন্মহীন 
খাড়া পাহাড়ের উপত্যকা।                 

স্বরবর্ণ

অলক বিশ্বাস

খুব ভোরেই শীতঘুম ভেঙে গেছে আজ।
আপাতশান্ত রক্তরাঙা আকাশ। ফুরফুরে মেঘ।
সাতসকালে চনমনে গাছেরাও । অন্যরকম দিন আজ।
দুহাতে ভরেছি ফুল।

রাজপথে ঘুমভাঙা ইতিহাস।
সমবেত মানুষেরা হাসছে-কাঁদছে- গাইছে হৃদয়ের কলি।
উৎসবে আপনজনেরা।

বারবার দেখছি নিজেকে।

আজ বেদনার নদীতে ভাসাবো সকাল।
আমলকি বাগানে চড়ুইভাতি,
নতুন ধানের গন্ধে বাঁধভাঙা হাওয়া লেখে নতুন স্বরবর্ণ
তোমার নাম...
আজ মুখে মুখে গান
আজ নদীর মুখে কথা
আজই নদী ডেকে জানালো সম্ভাষণ।
আজ দেখা হবে তোমার সাথে
আজ একসাথে দেব ফুল।
সন্ধ্যা নামুক, ষোলকলা চাঁদ আজ দেখবে তোমায়।
শস্যে পূর্ণ গোলা। দিঘিজল থৈ থৈ, আল্পনায় জেগে ওঠো বেলা
রোদ্দুরে দুচোখ স্বপ্নময়। কাঁদছি বলে আজ গোলাপ নীরব !


চির-স্বপ্নময়

সপ্তাশ্ব ভৌমিক

একুশে ফেব্রুয়ারি
ঘাতকের চোখ হল ভয়ানক
খাপখোলা তরবারি
একুশে ফেব্রুয়ারি
স্বপ্ন শহিদ শুয়ে আছে পথে
লাশ হয়ে সারি সারি
একুশে ফেব্রুয়ারি
চারটি প্রদীপ নিভে গেল ঝড়ে
ফিরল না কেউ বাড়ি
হৃদয়ের দরজায়
করাঘাত করে কিছু
অমলিন মুখ
ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে
ছিন্নভিন্ন শহিদের
রক্তাক্ত বুক
সেই স্মৃতি ক্ষয়হীন
বহমান জীবন্ত সময়
মৃত্যুকে মুগ্ধ করে
থাকে স্মৃতি চির-স্বপ্নময়!!!




উত্তরাধিকার





সৌমিত্র চক্রবর্তী



এখন অষ্টআশী শীত বাকী
এ শতক শেষ হতে,
আমার জীবন এখনো অনেক...


সেদিন ঝরা পাতা মচমচ শিউরে উঠেছিল
মা ডাকের জন্য গর্ভস্থ ভ্রুণ
গেঁথে গিয়েছিল বেয়নেটের ডগায়,
আ মরি বাংলাভাষা”-
মাত্র এই লাইন টুকুর জন্য
একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়ার বুক
রক্ত ঝরিয়ে দিয়েছিল,
আব্দুল সালামেরা তবুও
মা ডাক ছাড়েনি।




সেদিন ঢাকায় একুশের টগবগে তাজা রক্ত
আলপনা এঁকে গিয়েছিল
ইতিহাসে-প্রতিজ্ঞায়।
গত শতকের কঠিন চোয়ালের
দৃঢ়বদ্ধ পাঞ্জার সেই চিহ্ন বুকে নিয়ে
আমি তার উত্তরাধিকার।



উত্তরাধিকার

মৌ দাশগুপ্তা
সোনা মা আমার,
তোর কাছে রেখে গেলাম
নীল আকাশ আর রোদ্দুরের গল্প,
ভুশুন্ডী কাক,হিতোপদেশের পেঁচা আর বুড়ো বটের কাহিনী...
নদীর জল আর গরমের শুকনো তৃষ্ণার্ত বাতাসের সখ্যতা ,
ধুধু বালিয়ারীর বুকে চাঁদনী আলোর প্রেমগাথা,
বৃষ্টি আর চাতক পাখীর না মেটা চাহিদার হিসাব।
আমার গল্পে,আমার গানে, আমার কথায়, আমার ভাষায়,
সব দিয়ে গেলাম তোর দু কানে,দু চোখের কাজলে,
তোর সবুজ মনে, তোর চিন্তা জুড়ে।
তোমার কাছে রেখে গেলাম
আমার পরিযায়ী মন,আমার অভিলাষা,
আমার গোপনসুখ, আমার দুখবিলাস,
আমর কল্পনার জগত,আমার ভালোমন্দ সব অনুভব,
মেয়েলী পৃথিবী, ভালোবাসার নরম আলতো ছোয়াঁ ,
আমার সব সংযম, সব বাধানিষেধ,সব হাসিকান্নার পশরা।
আত্মজা তুই, নিজেকে উজার করে সব দিয়ে গেলাম
তোর প্রতিটি অনুভবে, রক্তবাহী শিরায়, মর্মে-মর্মে।
আর দিয়ে গেলাম,আমার মুখের বুলিতে, তোর মাতৃভাষায়,
সেই আজ কাল পরশুর, রোজকার ,বারোমাসের
খুউব আদরের,খুউব মন কেমন করা,খুউব ভরোসার,
সেই চিরকেলে সাবেকি ডাকটি...
"
মা ,ও মা, মাগো।।
সেটি




শুধু তোমার জন্য


ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


মাবলে ডেকেছি তোমাকেও
জননী, জন্মভূমি
আর মাগো,
বাংলাভাষাআমার...তুমি !


আগে কি কখনও ভেবেছি
ভাষার জন্য লড়াই
আগে কি কখনও করেছি
ভাষার জন্য বড়াই !


মাগো,
শুধু তোমারই কথা বলি...
যে ভাষায় তোমায় ডাকি
যে ভাষায় তোমার কথা লিখি
যে ভাষায় আমার প্রথম প্রেমের
ফোটাই কলি...


ও আমার বাংলাভাষা,
কত না সাধ, কত না আশা...




মাগো,
সবার কেন আসে না এমন ২১শে ফেব্রুয়ারী
সবাই কেন বলে না, মাগো
এসো, ভাষার জন্য লড়ি !




একুশের প্রভাত ফেরি


আলি রেজা


অশ্বের খুরের আঘাতে
ঝরা পাতা কথা বলে;
চেরাগের কাদা গলা আলো ঘিরে
পুঁথির পাতারা কথা বলা,
উবু হয়ে বসে
ছানিমাখা চোখ
জীবনের জলছবি দেখে,
তোমার হাত ধরতে পারি
ছুঁতে পারি ছাই মাখা হাতে
চিরল চিবুক,
এভাবে ধরতে পারি দেহঘড়ি,
কেড়ে নিলে বর্ণমালা
দুঃখিনী মায়ের আল জিভ
হৃদয় ধরি কি দিয়ে?


সারা রাত জেগে
নবান্নের পুঁথি-পাঠ শেষে
কিষানীর কাস্তে নিয়ে
জলছবি মাখা পাকানো লাঠির ঘায়ে
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে পয়ারের ঝংকার তুলে ছিনিয়ে এনেছি
মায়ের ভাষা অমিত আশা,
পদছাপ রাখে বর্ণমালা
একুশের প্রভাত ফেরিতে।





একুশে ফেব্রুয়ারি  



শর্মিষ্ঠা ঘোষ


বাস্তুচ্যুত বরিশালের জল চিকচিক বাবার চোখেরকোল
আম কাঁঠালের ছায়ায় এক দ্বীপবাড়ি ডিসপেনসারি
শৈশব বাতিঘর আশ্চর্য অববাহিকার মাটি নাড়িরটান

মায়ের আইবলে দিনাজপুরের আতাগাছের ছায়া ,ফাটাকপাল
সারসার চকমেলানো পাঁচবাড়ি ঠাকুরদালান একছাদ আকাশ
রাজবাড়ির দুঁদে উকিল দেশভাগের মামলা হেরে ভুত

আমি স্যাডোলাইনে ত্রিশঙ্কু এইসব উত্তরাধিকারের ঠেলায়
সম্বৎসর সাঁটলকক হয়ে রই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে
কেবল একুশে ফেব্রুয়ারি এলে আমার দুপা গাঁথে দুই বাংলায়

ভাষা আমার
পার্থ কর


কোন অমরা থেকে
অমরা হয়ে
জঠরান্ধকারে রক্তে মিশেছ -
জানি না ।
দিনে দিনে সাম্রাজ্য গড়েছ একদিন,
দৃপ্ত ঘোষনায়
জগতের সাথে সুপরিচয় লগ্নে
চিনিয়েছ নিজেরে -
কবে, মনে নেই !
শুধু জানি যে গর্জনে সিংহ ছুটে যায়,
যে কুহুধ্বনি কাব্য গড়ে,
টুঁটি চেপে ধরা যে আর্তনাদ -
ত আমারও ।
তুমিই শেখালে তোমাকে জানতে,
তোমাকে জানতে - জেনেছি আমায়ও,
আর
আমাকে জানতে বিশ্বকে ।

  বসন পরায় তোকে আমরা
যে যার মতো,খেলাচ্ছলে ।
...
ওরে অরূপা,
বিশ্ব-ব্রহ্মের ওঙ্কার-জাত
বিশ্বময় বহুরূপিণী -
তোর জন্য রেখে যাব
রক্তবীজের উত্তরাধিকার ।





একুশের অমরত্ব....

অনুপম দাশশর্মা

একুশের গায়ে আত্মার ছোঁয়া, রোঁয়া ওঠা রক্তের
অনুচক্রিকা যক্ষ হয়েছে স্বর্গীয় স্মৃতির,
আবেগের স্বর্ণালী ফলক স্বাধীনতার স্বাদে ভাষার মর্যাদার
মাতৃ বন্দনায়।
শব্দের কি পূর্ণ জ্যোতি, জীবন সমুদ্রে
ওতপ্রোত নান্দনিক সৌহার্দে।

অশুভ ক্ষমতা নখদাঁত আঁচড়িয়ে পারেনি
বাংলা ভাষার সর্বনাশে
প্রতিরোধের অকাট্য যুক্তি শ্রদ্ধায়
মাটিতে ঝরে গেল তাজা প্রাণের নিঃশ্বাস।

একুশের বাতাসে শুধু বারুদের গন্ধ!
উত্তাল মিছিলের পায়ে পায়ে বাংলার মান
কেড়ে নেওয়া প্রাণ স্তব্ধ করালো দুর্বৃত্তের শাসন।

বাংলা ভাষা সীমান্ত কাঁটা পেরিয়ে
অশ্রুর নোনতা স্বাদে মাথা নোয়ায় শহীদের পায়ে,
একুশের শ্বাসে।




একুশ আমার একুশ

শ্রী শুভ্র



অনেক নিঝুম রাতের বুকে
একমুঠো একুশ ছড়িয়ে দেখেছি, নিরব অশ্রুর চোখে
বর্ণীল আলোয় সূর্য ছলকে ছলকে ওঠে!
অনেক আর্তনাদে একুশ
ঢেলে দেখো
পৃথিবী ফলবতী হবে
সৃষ্টির বিষের বিন্দু ছেঁকে!
শ্যামলবরণ নরম বাংলার
ভিজে মাটির কষ্টে-
অনেক একুশ জমে আছে!


আমার একহারা ভালোবাসার তীব্র শিকড়ে
আকঁড়ে ধরেছি দেখো
বর্ণ বর্ণ একুশ! বর্ণময়
প্রত্যয়!
পলাশরাঙা দূরন্ত পথের গতির মতো
আমাদের মুখর কলতানে
মানচিত্র জুড়ে দেব একদিন
বন্ধু! একুশের ধারালো শক্তিতে!


এ আকাশের নীলে নীলে
রক্তিম নিঃশ্বাসে একুশ
ছড়িয়ে দিয়ে;
হৃদয় নিভৃতে
কলজে জুড়ে বর্ণমালার
মার্চপাস্ট! প্রস্ফূটিত সহস্রাব্দ আমার একুশে
হাঁটতে শিখবে একদিন!
বিন্দু বিন্দু রক্তিম সংগ্রামে!





তৃতীয় নয়ন খুলে যায় অসীম সাহসিকতায়


এ বি এম সোহেল রশিদ


বিজয়ের মাসের বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়
টিএসসিকে পাস কাটিয়ে শহীদ মিনারের দিকে হাঁটছি
প্নির্জন রাস্তা, পঞ্চাশ কদমের মত এগুতেই
পিছন থেকে কেউ ডাকল দাড়াও’’
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। কোথাও কেউ নেই
কয়েক কদম এগুতেই দাড়াও বলছি
ঘুরে দাড়াতেই তিন জন এগিয়ে আসলো
প্রথম জন বরকত, দ্বিতীয় জন ড. মুনির চৌধুরী
তৃতীয় জনের দিকে তাকাতেই বলল
আমি ৩০ লক্ষ শহীদের একজন
আমি ভরকে গেলাম, স্বপ্ন দেখছি নাতো
ওনারা তিন জন এক সাথে বলে উঠল
‘‘
আমাদের জন্য গড়া স্মৃতির মিনারে ওরা কারা?
বুকের পাঁজরে দাড়িয়ে অবলীলায় মিথ্যে বলে যাচ্ছে?
দিয়ে যাচ্ছে মিথ্যে আশ্বাস
বিনষ্ট করছে কোটি মানুষের বিশ্বাস
ওদের কারণে আমাদের রক্ত মুছে যাচ্ছে?’’
আমি কাঁপা কণ্ঠে সাহস করে বললাম
শহীদের রক্ত মুছে যায় না
আমাকে ধমকের সুরে বলল
:
মায়ের ভাষাকে কি আনুষ্ঠানিকতার বাইরে নিতে পেরেছ?
শিক্ষার আলো কতটুকু ছড়িয়ে দিয়েছ আমার দেশে?
আচার আচরণে কতটুকু বাঙ্গালীপনা আছে তোমার মাঝে?
:
বাক স্বাধীনতার কতটুকু ভোগ করছ?
বুদ্ধিজীবীরা আজ দলবাজিতে বিকারগ্রস্ত
মন গড়া ইতিহাস লিখতে ব্যস্ত
:
স্বাধীনতায় কেন কাটা তারের বেড়া
রাজাকারের গাড়িতে বংশ পরিক্রমায়
উড়ছে লাল সবুজের পতাকা
তোমাদের উন্নাসিকতায় মুক্তিযোদ্ধারা থমকে দাড়ায়
তাঁদের গায়ে নানান দলের তকমা
শহীদ পরিবারের সদস্যরা আজ মানবতার কাঠগড়ায়।
আমি অশ্রু সজল চোখে তাকিয়ে থেকেছি
কোন উত্তর দিতে পারিনি…. এর উত্তর আমার জানা নেই।
পরে জানলাম শহীদেরা ধমক দেয় না
বিবেককে জাগ্রত করে মানবতাকে উসকে দেয়
দেশপ্রেম ছড়িয়ে দেয় সূর্যের আভায় লাল সবুজের পতাকায়
আমার তৃতীয় নয়ন খুলে যায় অসীম সাহসিকতায়।




দুয়ারে একুশ


তরুণ বসু

সজনে গাছ থেকে ফুল ঝরছে
আবার দুয়ারে একুশের গন্ধ
আমি মুঠো ভরে সজনে ফুল কুড়িয়ে নিলাম
আর তাকিয়ে দেখলাম
শিমুলের লাল এখনো দেখা যাচ্ছেনা ।

পর্ণমোচী অন্যান্য বৃক্ষ একই রকম নিরাভরণ
শীত চলে যাচ্ছে আড়মোড়া ভেঙ্গে মাথা তুলছে আমের মঞ্জরী ।
আমি জানি একুশ চলে গেলে শিমুল ফুটবে
বাংলার পলাশও অপেক্ষায় আছে
রঙে রঙে রঙ – একাকার হবে
আর আমি সকল কাজের মধ্যেও কান পেতে থাকবো
রফিক-সালাম-জব্বর-বরকতের জন্য ।

আমার কাঁটাতারের বেড়া নেই, নো ম্যানস ল্যান্ড নেই,
পৈতে-তিলক-মালা নেই, দড়ি-টুপি-লুঙ্গির সাজ নেই
-- আমার উচ্চারণে আছে বাংলা ভাষা , আছে
চর্যাপদ থেকে উত্তর-আধুনিক সাহিত্যের সমুদ্র
আর সাতাশ কোটি বাংলা-ভাষী দেব-দেবী ।


ইতিহাস বলি বারবার
 শামীম পারভেজ
ফেব্রুয়ারীর একুশ এলেই
নগ্ন পায়ের মাজারে যাওয়া
আর শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া ।
মার্চের ছাব্বিশ এলেই
সাভার যাওয়া দলে দলে
এ দিনটা চলে গেলে স্বাধীনতা যায় ভুলে।
ডিসেম্বর ষোল এলেই
বিজয় বিজয় তাদের মুখে
দরিদ্রের হাহাকার তারা তো আর নাই সুখে ।
নতুন প্রজন্ম বড়-ই অসহায়
জানেনা তো এর ইতিহাস
আমরা তাদের কি শিখাচ্ছি
করে যাচ্ছি সর্বনাশ ।
এখনোতো সময় আছে
ইতিহাসটা জানাবার
চলো তাদের সবাই মিলে
ইতিহাস বলি বারবার ।

আমার ভাষা 
অভিলাষা

বাংলা আমার মায়ের ভাষা,
প্রথম মাডাক, দেখায় দিশা
বাংলা উষার প্রথম হাসি।
                            রাখালছেলের মিষ্টি বাঁশী ।


কিংবা পাখীর মধুর গান,
স্বচ্ছতোয়ার সে কলতান।
বাংলাতেই গান,কথা বলা,
কান্নাহাসির আজব খেলা,
প্রেম বিরহ,আড্ডাবাজি,
মান অভিমান,শব্দ-বাজি,
জমানো খুশী ,গোপন ব্যাথা,
পরের ঘরের গোপন কথা,
আমার বাংলা, ছন্দমধুর,
আলঙ্কারিক, শব্দবিধুর।

অভিধানিক কথারমালা,
কথাও জানে হূলের জ্বালা
ঢেউ ভাঙ্গানি চোখের জল।
হাসিখুশীর পল অনুপল
মায়ের মুখের রূপকথাটি
গল্পগুজব,বা দাঁতকপাটি,
ভাষামেয়ে,আমি কথাকলি।
বাংলা আমার মুখের বুলি।

বর্ণমালা


জুলফিকার শাহাদাৎ

ভাষা শহীদের লাল জামাটায় অনেক অনেক স্মৃতি -
কিছু স্মৃতি তার মায়ের
কিছু স্মৃতি তার গাঁয়ের
কিছু স্মৃতি তার বাবা ও বোনের, ভাইয়েরও স্মৃতি আছে
মা খুঁজে ফেরে খোকনের স্মৃতি বর্ণমালার কাছে।

বর্ণমালায় সালামের ছবি,
রফিকের ছবি,
বরকতও আছে জেগে -
মা মা বলে ডাকে বর্ণমালারা উচ্ছ্বাসে, আবেগে।
বর্ণমালারা মার সন্তান
বর্ণমালারা জয়, জয়গান -
বর্ণমালার পরতে পরতে সালাম রফিক থাকে
শহীদ মিনার প্রতি রাত ভোর মা মা বলে ডাকে।


প্রবীর বিকাশ সরকার
পন্ডিতি



শোনতো ন্যাড়া, বলতে পারিস

ক্যামনে এল ভাষা ?

সঠিক যদি বলতে পারিস

                        পদক দেবো খাসা ।

তা জানিনা পন্ডিতদা
তুমিই বাপু বলো,
উত্তরটা তোমার চোখে
করছে টলোমলো ।

সেতো অনেক দীর্ঘ কথা
এখন তবে বাদ দে’
বরং একটি গ্রন্থ লিখি
যদি কুলোয় সাধ্যে ।

তার আগে কও ক্যামনে এলয়
বাংলা ভাষা, অক্ষর ?
এই সেরেছে , প্রেসার বেড়ে
দিচ্ছে মাথা চক্কর ।

ভাষা টাসা বাদ দে ন্যাড়া
আমাকে তুই মাফ কর,
পন্ডিতি ফের ফলাই যদি
মারিস গালে থাপ্পড়
 (২)
আমার ভাষা

সেই ভাষাতে কথা বলি
এবং রাখি আশা
সে ভাষাতেই স্বপ্ন দেখি
জন্মে ভালোবাসা ।
সেই ভাষাতে নেই ভেদাভেদ
সবাই তাতে হাসে
আমার ভাষা সুবাস হয়ে
বিশ্ব জুড়ে ভাসে ।


বিজয় উৎসবের রাতে
মিত্রপক্ষ সাই

ব্যাবধান কমে গেলে এ শহরের

রাস্তা গুলির শরীর জরিয়ে রাখে শীত সকাল। স্বাধীনতার মানে কি জানেনা এই শহর।
বিশেষ কিছু দিনে একটু যত্নআত্তি বাড়ে এই আর কি।

ব্যাস্ততা কমে যায় কয়েক ঘণ্টার জন্য।
আপত্তি নেই এই শহরের, যদি এই পথে কেউ হেটে যেতেযেতে

প্রেমের কথা বলে,বিজয়ের উৎসব করে।
ফুল ছড়িয়ে যায় অসাবধানে বা ইচ্ছে করেই।
এই শহরে বাক্সবন্দী শহরের ইতিকথা, তোমার আমার রাত্রি উৎসবের কথা,
বিজয়ের কথা। প্রথম স্বাধীনতার কথা।

নীল মুনিয়া পাখীটি এখনও এসে বসে এই শহরের
সবচেয়ে নীচু গাছটিতে। নিমন্ত্রণ দিয়ে যায় কাল সকালের।
কাল সকালে তুমি আসবে বলেছ, তাই আমিও বিজয়ের উৎসবে
সামিল হবো খুব সক্কালবেলায়।
তুমি পাশে থেকো, ফিরে এসো এই সবুজ
গালিচা বিছানো দেশে। এ তোমারই জন্যে।
বুলেট খেয়ে লাল সূর্য দিয়েছো আমায়।
আমি তোমায় সবুজ দেশ দিলাম। নিঃশ্বাস ফেলতে দিলাম,
এই শীত শহরের পথে ফুল বিছিয়ে দিলাম।
উৎসবের রাতে আজ ব্যাবধান কমে গেছে এই শহরের।
তুমি ফিরে এসো।


এখন নিশ্চিন্ত হয়োনা
দেবতোষ মাইতি

এখন বিশ্রাম নয়
যদি ভাবো শরেউনিঃশেষ,
যদি ভাবো বারুদের গন্ধের বিনিময়ে
নরম আলোর মাটি শান্ত হয়ে গেছে,
বড় ভুল হবে ।
বিষাদ মাখা লাবণ্যময়ী মা সব ভুলে গেছে,                   
ভুলে গেছে নাড়ীর বাঁধন ছেড়া ভাওবাসা
ফাগুনের পলাশের মতো
টুপতাপ ঝরে গেছে ভয়ে,
একি শুধুই স্মরণের দিন
আর ব্যাথাতুর ইতিকথা ।
আমরা কি বিশ্বাস করি
এ মাটি জহ্লাদ হয়ে গেছে
তাই কোন বিশ্রাম নয় ।

একুশতো শপথের দিন
চূড়ান্ত সাফল্যের আগে
সংহত প্রস্তুতির দিন।
টের পাওনা
হায়নারা জেগে আছে
রক্তের লোভে।
সতর্কতার বড় প্রয়োজন ভায়ে ভায়ে বিবাদ না হয়
প্রস্তুত থাকা তাই
মনে রাখা দরকার
একুশ মানে শপথের দিন ।


শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর
মৌ মধুবন্তী

এই প্রাণে পরান থাকতে,সুবিধেবাদীদেরকে চুর্ণ করতে
আজ জেগেছে প্রজন্ম শাহবাগে, আজ জেগেছে সচেতন নাগরিক
দেশে বিদেশে--ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই,কারো ক্ষমা নেই- যারা দেশের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্র করে, যারা রাজাকার ও রাজাকারের মত আচরণ করে , যারা দেশের
সৌকর্য নষ্ট করে, আজ শাহবাগ রুখে দাঁড়িয়েছে তাদের
বিরুদ্ধে , প্রবল বন্যার মত সবার প্রাণে আজ শক্তি সঞ্চারিত
কোন বিদেশি আঁতাত পারবে না, পারবে না, পারবে না আমার দেশে
পেশীবাদী শক্তি দেখাতে , তাদের হিস্যার খাতায় নাম লিখতে
আমার দেশ বঙ্গোপসাগরের জলে ধোয়া স্নিগ্ধ সুরভিত, কল্যাণের দেশ
বাংলাদেশ, মানবতা এখানেই জাগরিত হবে অনিমেষ, তুলে নাও
তোমার করাল হাত আমার দেশের সীমানা থেকে । নইলে কুঠারের আঘাত
ব্যর্থ হবে না জেনো। এই দেশ প্রজন্মের দেশ, এই দেশ মানবতার দেশ
এই দেশ কবিতার দেশ। এখানে রবে না কোন বর্বরতা, হিংসা ও দ্বেষ
এই বাংলা সুর্যস্নাত অপুর্ব সোনালি আলোয় গড়া দেশ। প্রজন্ম চত্বর শাহবাগ জয় হোক। 









মৃণ্ময় দেব



বাঙালি আর সমস্যা প্রায় হরিহর আত্মা। সমস্যা যেমন বাঙালির পিছু ছাড়ে না, বাঙালিও তেমনি সমস্যা না থাকলে যেন হাঁপিয়ে পড়ে। এটা গুণ কিংবা দোষ, সে বিচার আপাতত নাহয় মুলতুবি থাক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালির এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই, নতুন করে আরেকটা সমস্যা খাঁড়া না করাই মঙ্গল। দেশ বিভাগের ছয় দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, অথচ শেকড় ছড়িয়ে থিতু হতে পারে তেমন স্বভূমির সন্ধান বাঙালির বরাতে আজো জুটল না। ত্রিপুরায় যারা বসবাস করছেন তাদের অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল বলা যায়। উত্তরপূবের অন্যান্য প্রদেশে বসবাস করা বাঙালিরা আজো বহিরাগতপরিচয় নিয়েই কোনক্রমে জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে সঙ্গীন অবস্থা অসমের বাঙালির। আরো স্পষ্ট করে বললে মূলত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির অস্তিত্বের সংকট সবচেয়ে গভীর এবং তীব্র। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে খানিকটা সুবিধেজনক অবস্থায় রয়েছেন এবং কেবল মাত্র ভাষা-কেন্দ্রিক আন্দোলনের চৌহদ্দিতেই নিরাপত্তার চাবিকাঠি মিলবে এরকম এক ইউটোপিয়ায় আক্রান্ত হয়ে খোশ-মেজাজে দিনাতিপাত করলেও বস্তুত পরিস্থিতি যে অতটা সরল নয় সেটা বোঝার আগ্রহ সেভাবে চোখে পড়ে না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই উদাসীনতা যে জটিল সমস্যা তৈরি করতে পারে তা হৃদয়ঙ্গম করা অবশ্যই দরকার। 
            বিগত চার দশক যাবৎ বহিরাগতদিয়ে শুরু করে ভায়া (via) ‘বিদেশিহয়ে অবশেষে বাংলাদেশি’ (? বাঙালি)-তে থমকে থাকা অসম আন্দোলন যে ঘোলাটে রাজনীতির ব্যুহে প্রবেশ করে পালাবার পথ পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না তার দরুণ অনেকেই আপাতত স্বস্তি বোধ করছেন, ভবিষ্যতের চিন্তা শিকেয় তুলে দিয়ে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির পক্ষেও এই অ-বিবেচনা ক্ষতিকারক প্রমাণিত হতে বাধ্য। বিদেশি নাগরিক সংক্রান্ত সমস্যার এক মৌলিক ও চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে গেছে নয়ের দশকে এসে। অসম গণ পরিষদ দল সরকার গঠনের আগে পর্যন্ত অসমীয়াভাষীরা সমস্যাটিকে ও তৎ সংক্রান্ত আন্দোলনকে তথাকথিত জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতেই বিচার বিবেচনা করতে অভ্যস্ত ছিলেন। অ-গ-প দলের দু দফার শাসনকালে এবং বিগত পনেরো বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় অধিকাংশের দিবাস্বপ্ন ভাঙতে দেরি হয়নি। দলটির প্রতি যে অনাস্থা নির্বাচনে লাগাতার পরিলক্ষিত তা থেকে একথা স্পষ্ট যে অসমের মানুষ বিদেশি জুজুর চেয়ে রুটি-রুজির সমস্যাকেই মৌলিক সমস্যা রূপে পরিগণিত করার জরুরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠেছেন। আসু-র আন্দোলনকে বাঙালি বিরোধী বিবেচনা করতে অভ্যস্ত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিদের একাংশও কিন্তু নয়ের দশকে এসে অবস্থান পাল্টেছেন কিয়ৎ পরিমাণে। ৭১ এর পরে আসা বাঙালিরা বিদেশি সেকথা মেনে নিয়েছেন মূলত ওই সময়ে বি-জে-পি হাওয়া জোরদার থাকার ফলে। অর্থাৎ, আন্দোলনটা এদের কাছে আর সর্বাংশে বাঙালি বিরোধীরইল না। 
               বরাকে একটু ভিন্ন চিত্র দেখা গেল। সেখানে বাংলাদেশি (আরো সঠিক ভাবে বললে মুসলমান বাঙালি)রা হল বিদেশি। ভাষাগত ঐক্যের বিষয়টা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ল। আর তাই অ-গ-প দলের হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এল বাঙালি মুখ, এমনকি নির্বাচিতও হওয়া গেল বিস্ময়কর ভাবে। মোদ্দা কথাটা হল উভয় উপত্যকায়ই সমস্যাটিকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন প্রকট হল। সেকারণেই অগপ-ভাজপা সমঝোতা সম্ভব হয়, যদিও ভা-জ-পা জাতীয় দল বলে মাঝে মাঝে হিন্দুরা শরণার্থীধুয়ো তোলে। রাজনৈতিক নানান জটিল সমীকরণের ফলে বাঙালিদের এক হতবুদ্ধি অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে। যথার্থ কোনও সংগঠন না থাকার ফলে পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে অনেকেই নানান দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে, বর্তমান নিবন্ধকারও একটু-আধটু লিখেছেন। তবে এখানে অন্য একটি জরুরি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করব। 

           তত্ত্বগত ভাবে যারা বিদেশি নয়, অর্থাৎ,৭১ এর আগেই যে বাঙালিরা অসমে এসে বসবাস শুরু করেছেন, স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে, তাদের উভয় গোষ্ঠীই কিন্তু এক নতুন প্রজন্মের জন্মদাতা। বাস্তুভিটে ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে যারা এসেছেন, আর নতুন প্রজন্মের যে বাঙালির জন্ম বস্তুত এই উত্তরপূবের কোমল মাটিতে তাদের চিন্তা-চেতনার প্রকৃতি ও পরিধি ভিন্ন হতে বাধ্য। কেননা, বাপ-ঠাকুর্দার মতো এদের কোন হারানো স্বদেশেরস্মৃতি নেই। অথচ, জ্ঞানচক্ষু মেলার পর থেকেই বাবা-কাকাদের বিলাপের দৌলতে এদের মধ্যে এ ভূমি আমার নয়গোছের এক মানসিকতা গড়ে ওঠার অবারিত সু্যোগ পেয়েছে ও ক্রমে বদ্ধমূল হয়েছে। যে মাটিতে শেকড় রয়েছে সেই মাটির সঙ্গেই ফলে তৈরি হয়েছে নিদারুণ এক আত্মিক বিচ্ছিন্নতা। একদিকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই উদ্বাস্তু মানসিকতা আর অন্যদিকে আশির দশকের আন্দোলন-মার্কা ভাষাকেন্দ্রিক উগ্র-জাতীয়তাবাদী প্রত্যাখ্যান, দুয়ে মিলে বস্তুত দেহে-মনে নিজভূমে পরবাসী হয়েছে এই নতুন প্রজন্মের বাঙালি। দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হওয়ার থেকেও তা ভয়ানক। মানুষ যখন আত্মিক ভাবে উদ্বাস্তু হয় তখন কোন ভূমিকেই আর স্বভূমি বলে মনে হয় না। বরাক উপত্যকার বাঙালির ক্ষেত্রেও এই উদ্বাস্তু মানসিকতা বর্তমান যদিও তার চরিত্র আলাদা।                       
                 ’৬১-র ভাষা আন্দোলন নিয়ে বরাকের বুদ্ধিজীবীদের গৌরবান্বিত ও আবেগাপ্লুত হতে দেখা গেলেও বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষ ভাষিক ঐক্য গড়ে তোলার কোন সদর্থক প্রয়াস দৃষ্টিগোচর হয় না আদৌ। এখনো নির্বাচনের অঙ্ক কষা চলে হিন্দু-ভোটার ও মুসলমান-ভোটারের সংখ্যা কত তার নিরিখে। ভৌগোলিক সান্নিধ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করতে পারেনি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমীয়া-বাঙালির মধ্যে যে দূরত্ব বরাক উপত্যকায় হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির মধ্যেকার দূরত্ব অন্তত পরিমাণগত ভাবে তার চেয়ে কম নয়সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু-বাঙালির ভূমিকাই মুখ্য। সামাজিক কর্তৃত্বের ভূমিকায় থাকা হিন্দু-বাঙালির অংশটি মূলত অবিভক্ত শ্রীহট্টের অধিবাসী। দেশভাগ ও বিতর্কিত গণভোটের ফলে শ্রীহট্টের যে অংশ ভারতভুক্ত হয় সেখানে এই অংশটি স্বাভাবিক কারণেই সামাজিক আধিপত্য সাব্যস্তের যাবতীয় প্রচেষ্টা আরম্ভ করে। সোজা কথায় দেশের বাড়ির নকলতৈরির জন্য ব্যস্ত এবং উৎসাহী হয়ে পড়ে। নিম্ন বর্গের হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির সঙ্গে এদের যে দুরত্ব দেশভাগের আগে ছিল দেশ বিভাজনের পরেও তা বহাল রইল। এটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। কর্তৃত্বকারী বাঙালির এই শ্রেণিটি উপায়ান্তরবিহীন হয়ে অসম-ভুক্তি মেনে নিলেও মানসিক ভাবে অসম তথা উত্তরপূর্বাঞ্চলের অন্যান্য প্রদেশের অধিবাসীদের থেকে স্বেচ্ছায় এবং সচেতন ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল। বরং ভাষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এরা কলকাতামুখীনতাকেই জরুরি বলে সাব্যস্ত করে বসল। অর্থাৎ, এদের মনোভূমিবাসভূমিপৃথক হয়ে গেল। শারীরিকভাবে তো ছিলই, মানসিক ভাবেও উদ্বাস্তু হল। উভয় উপত্যকার বাঙালির মধ্যেই এই উদ্বাস্তু-মানসিকতা প্রকট হল, যদিও তার পেছনের ঐতিহাসিক এবং আর্থ-সামাজিক কারণ ভিন্ন। এই বিষয়টি নিয়ে নতুন প্রজন্মের বাঙালির চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আজ। 
                অসমের আর্থ-সামাজিক জটিল পরিস্থিতিতে বিদেশি জুজুর ভয় দেখানোর নিরাপদরাজনীতি অসম তথা অসমের স্বার্থকে যেভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছে তার মাশুল কিন্তু গুণতে হচ্ছে ভাষা-ধর্ম নির্বিশেষে সকল অসমবাসীকেই। এই উপলব্ধি ভীষণ জরুরি এসময় অসমীয়া ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই। উভয় সম্প্রদায়ের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন তরুণদের তাই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এ বিষয়ে জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অসমীয়া এবং বাংলাভাষীদের উভয়কেই আজ অথবা কাল এই উপলব্ধি লাভ করতেই হবে, সে প্রক্রিয়া ইতিহাসের নিজস্ব নিয়মেই হয়ত ইতিমধ্যে এক সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রয়োজন কেবল সেই সম্ভাবনাকে চিনে নিয়ে ইতিহাসের গতিপথকে বাধাহীন করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হওয়া। উত্তরপূবের নব প্রজন্মের বাঙালির সে উপলব্ধি একেবারেই নেই তা নয়, তবে উপলব্ধি অনুসারে সক্রিয় ভুমিকা গ্রহণের জন্য সচেষ্ট হওয়া দরকার, অবিলম্বে। এটাই সময়ের দাবি, উভয় সম্প্রদায়ের কাছে। দাবি মেনে সেতুবন্ধনের শর্ত পূরণে কৃতকার্য হলে সুদিন আসবে উভয় সম্প্রদায়ের জন্য, অন্যথায় উত্তরপূবের হিন্দু ও মুসলমান বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যতর বিকল্পের অনুসন্ধানে ব্রতী হতে হবে।



ভাষাহীন
অমিতাভ দেবচৌধুরী


আমার নিজের কোনো ভাষা নেই,

আমি তাই প্রতিদিন তোমার ভাষার খোঁজে

রাতের আলখাল্লা আর দিনের পকেট চুরি করি ৷

চুরি করা পাপ ঠিক,কিন্তু ভাষাচুরি ?

ফুলচুরি চুরি নয় ,ভাষাচুরি তা-ই ৷
আমিও ডাকাত হই, কেননা আমার ভাষা নাই ৷

মাতৃভাষা ? তাকে যদি ভাষা বলে ধরি,
গতকাল রাতে যে হে মণিপুরী ছেলেটির
মন গেছে চুরি ,তার খোঁজে আমার ভাষাকে আমি
অভিযুক্ত না করে পারিনি---কেন ওই চুরি-যাওয়া
মনের ভাবনাস্রোত আমার ভাষার  জানা নাই ?
ভাষা নাই,আমার সত্যিই কোনো ভাষা জানা নাই ৷

কিংবা যে খাসিয়া ছেলে ,নাকে সিকনি, ভুলে গেছে হাসি
কেননা ভিক্ষার  থালা তার তিনদিন রয়েছে উপোসি
আমার ভাষাকে আমি পেরেছি পৌঁছোতে তার নিদ্রাহীন ঘরে?
যে ভাষায় কথা বলে মুসলিম চাষি,আমি তার দুয়ারে দুয়ারে
পেরেছি কি মেঘ হতে ? আমার মায়ের ভাষা প্রতিরাতে
নিজের কাছেই ফিরে আসে,আমার প্রাণের ভাষা
অসমিয়া একটি মেয়ের হাসির কিরণ ভিক্ষা করে ৷
কাব্যের ব্যর্থতা তবে এই ? কবিতায়ও
প্রতাপের ভাষা এসে ঢেকে ফেলে প্রাণের সে সোঁদা ভাষাকেই ?


আমার এ ভাষা তুমি কেড়ে নাও,লিখবো সে অন্তহীন
নৈঃশব্দ্যের এঁটো ভাষাতেই ৷
আমার নিজের কোনো ভাষা নেই, মাতৃভাষা নেই ৷


বাংলার তৃতীয় ভূবন ঈশাণ বাংলা

  ফা ল্গু নী মু খো পা ধ্যা য়



        ‘ঈশান বাংলা’ – এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী তাঁর একটি কবিতায় , বরাক উপত্যকায় ১৯৬১র রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের রজত জয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষ্যে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত একটি ফোল্ডারে । কবিতাটি দিলাম

                 

দশটি ভাই চম্পা আর একটি

পারুল বোন,
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল
এই যে ঈশাণ কোণ 
কোন ভাষাতে হাসে কাঁদে
কান পেতে তা শোন ।
শুনলি না ? তো এবার এসে কুচক্রীদের ছা
তিরিশ লাখের কন্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা ,
বাংলা আমার মাতৃভাষা
ঈষাণ বাংলা মা ।

সংশয় নেই বরাক উপত্যকাকে বাংলার তৃতীয় ভুবননামে যারা আখ্যায়িত করেছিলেন তাদের দৃষ্টি ছিল সুদূর প্রসারী । ঔপনিবেশিক মানসিকতায় চাপা পড়া বাঙালির জাতি সত্তার এক সাহসী ঘোষণা - সেই মানসিকতা কাটিয়ে ওঠার । বরাক উপত্যকার বাঙালিদের একটা সঙ্গত অভিমান আছে , অভিমান নয় মর্মপীড়াও । বিশ্বের বৃহৎ বাঙালি সমাজ বরাক উপত্যকার মানুষের বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে চায়না । একুশে ফেব্রুয়ারি মহা ধুমধামে পালিত হয়, বিশেষত ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে । তার পাশাপাশি ১৯সে মের কথা বরাকের সীমা পেরোতে পারে না । বরাকের সচেতন বাঙালিদে্গালিসুতরাং এই মর্ম পীড়া আছে যে বৃহৎ বাঙালি সমাজের কাছে বরাকের বাঙ্গালিদের অবস্থান উপেক্ষিত । বাংলার তৃতীয় ভুবনএর যে ধারণা, তা এই অবজ্ঞা, উপেক্ষা থেকে সঞ্জাত এক দৃপ্ত প্রত্যয়েরই ফলশ্রুতি । যারা নিজ মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিতে পেরেছে, তারা বাঙালি সত্তাকেও বৃহৎ বাঙালি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে এই দৃপ্ত প্রত্যয় ।  এই যে ,একই ভাষা পরিচয়ের সূত্রে পৃথক একটি ভাষা অঞ্চল ঈশান বাংলাপরিচয় দেওয়া, সেটা মূল ভুখন্ডের  বাংলা ভাষীরা কি ভাবে গ্রহণ করবেন সে অন্য কথা , সমাদর যে করবেননা সেটা জানা কথা , কিন্তু একটা ভাষা-আবেগ গত বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকেই তাদের তৃতীয় ভুবনের ধারণাটির উদ্ভব ও বিকাশ তাতে তো কোন সংশয় নেই ! পশ্চিম বঙ্গনামক ভৌগোলিক অঞ্চলটাই বাংলাভাষারমূল ভূখন্ড এমন ধারণায় ভাষাগত আধিপত্যবাদের গন্ধ থাকতে পারে কিন্তু ইতিহাস চেতনা নেই । ঔপনিবেশিক প্রয়োজন ও রাজনৈতিক কারণে বাংলার ভৌগোলিক বিন্যাশ একরকম হয়তো হয়েছে কিন্তু সেই ভৌগোলিক বিন্যাশের বাইরে  বাংলা ভাষার যে ভুবন তা মূল বাংলা ভাষাঞ্চলের বাইরে এবং উপেক্ষিত হয়ে থাকবে কেন ? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের দিতে হবে বৈকি ! আচার্য সুনীতি কুমার চট্টপাধ্যায় লিখেছেন বাংলা ভাষা গড়িয়া উঠিবার কালে, এবং তাহার পরে কয়েক শত বৎসর ধরিয়া বঙ্গভাষী জঙ্গণের নিবাস-ভূমি দুইটি প্রধান নামে অভিহিত হইত গৌড়বঙ্গউত্তরবঙ্গ ( বরিন্দ বা বারেন্দ্র ভূমি রাজশাহী, মালদহ, বগূড়া, পাবনা) ও রাঢ়( এবং সুহ্মপশ্চিম বঙ্গ বীরভুম,মুর্শিদাবাদ,বর্ধমান, হুগলী, হাওড়া, বাকুড়া ও মেদিনী পুর এই অঞ্চলগুলি লইয়াগৌড় দেশ...আর সুদূর প্রাচ্য বাংলায় ময়মনসিংহ, শ্রীহট্ট, কাছাড়, কুমিল্লা,ও চট্টল অঞ্চল এই সমস্ত ধরিয়া বঙ্গদেশসমগ্র গৌড়বঙ্গ প্রদেশের আর কতকগুলি বিভাগ  জনসমাজে প্রচলিত ছিল রাঢ় ,সুহ্ম,ঝাড়খন্ড (মানভুম, পুরুলিয়া, সিংভুম), কর্ণসুবর্ণ বা কান সোনা, বরেন্দ্র, সমতট, বাগড়ি (সুন্দর বন অঞ্চল), বঙ্গ, কামতা বিহার, ময়মন সিংহ , চট্টল, ত্রিপুরা প্রভৃতি ।আচার্যের এই লেখা ১৯৬৭ সালে, তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়নি । পুরাতাত্বিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে অতি প্রাচিন কালে বাংলা ভাষী আরো অনেক জনপদ গড়ে উঠেছিল । আচার্য সুনীতি কুমার বাংলা ভূখন্ডের অন্তর্গত যে সমতটঅঞ্চলের কথাউল্লেখ করেছেন এখনকার ত্রিপুরা তো সেই সমতটের ই একটি অংশ ছিল । 
অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জয়ন্ত ভূষণ ভট্টাচার্যর গবেষণা থেকে বরাক উপত্যকার সমতট রাজ্যের বিস্তৃতি এবং বাংলাভাষী হরিকেল রাজ্যের কথা জানা যায় । বরাক উপত্যকায় প্রাচিন হেড়ম্ব রাজ্যে সমৃদ্ধ বাংলা গদ্য চর্চার নিদর্শন রয়েছে । বাংলা ও বাংলা সাহিত্যের প্রত্যেকটি অঞ্চল সৃষ্টির আপন বৈভবে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে , সেই সব ভাষাঞ্চলের মানুষের ভাষা পরিচয়ের প্রতি, তাদের সাহিত্যের প্রতি তথাকথিত মূল ভূখন্ডের মানুষের শ্রদ্ধাহীনতা, উপেক্ষা আমাদের ভাষা প্রেমকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় ।
          
           ১৯৬১র বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের পৃষ্ঠভূমি ছিল নিশ্চিত ভাবেই সেখানকার বাঙালি দের ভাষা পরিচয় গত অস্তিত্বের সঙ্কট, যা ঘণীভূত হয়েছিল রাষ্ট্র প্ররোচিত অসমীয়া  ভাষা সম্প্রসারণ বাদের কারণে । ১৯৬০এর ২৪শে অক্টোবর আসাম ভাষা বিল আইনে রূপান্তরিত হয় এবং সারা রাজ্যে অসমীয়া ভাষাকেই রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে গন্য হল  অসমের বৃহৎ একটি ভাষিক জনগোষ্ঠি বাঙালি , তারা বাংলাকে অসম রাজ্যের ২য় সরকারি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করলেন । কালক্রমে সেই ভাষা আন্দোলন কাছাড় জেলায় কেন্দ্রীভূত হল । ১৯৬১র ১৯শে মে পুলিশের গুলিতে এক তরুণী সহ ১১জন ভাষা শহিদের মৃত্য সেই আন্দোলনকে মহিমান্বিত করেছিল । ঠিক একমাস পরে ১৯শে জুন হাইলাকান্দি শহরে এক ভাতৃঘাতী দাঙ্গা হল এবং কাছাড়ের ভাষা আন্দোলন থমকে গেলো । কিন্তূ এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে জন জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তারই ফলশ্রুতিতে অসম ভাষা আইন ১৯৬০কে সংশোধিত করে ১৯৬১তে বরাক উপত্যকার জন্য বাংলাকে সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হলো । ভাষা আন্দোলনের সাফল্য গুলিকে ধরে রেখে বরাকবাসী বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের সঙ্কট কাটিয়ে উঠছেন , শিকড়ের সন্ধান করছেন, তথাকথিত মূল ভুখন্ডের বাঙ্গালিদের উপেক্ষা আর তাদের কিছুমাত্র বিচলিত করেনা ।
          
বাঙ্গালির আর এক স্বদেশ বাংলাদেশেরসুখ্যাত ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন বরাকের ভাষা সংস্কৃতি চেতনার কথা এই ভাবে প্রকাশ করেছেন ১১জন শহিদের স্মৃতিস্তম্ভের ভেতরে সূর্য হয়ে আছে তাদের ভাষার লড়াইএর ইতিহাস’  সেই সূর্যের দীপ্তিতে একাত্মবোধ করবো না কেন আমরা বাংলা ভাষার তথাকথিত মূল ভুখন্ডের বাঙালিরা ! ঈশাণ বাংলাতো আমারই আত্মজ !                        (পুণঃপ্রকাশ)
সূত্র – ‘ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক প্রভাব’ – ইমাম উদ্দিন